সবার প্রিয় আপা ও মানুষ গড়ার কারিগর সঙ্গীতা ইমাম

সঙ্গীতা ইমাম হলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকা। শিক্ষকতা পেশা হিসাবে নিলেই যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। তিনি কিন্তু সবার প্রিয় আপা নামে বেশ পরিচিত। উনি নিজেকে শুধু চার দেয়ালের মাঝে রাখেন নি, সবাইকে সহযোগিতা এবং পরামর্শ প্রদান করে, সবার মনে স্থান করে নিয়েছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর একজন কর্মী ও সহসাধারণ সম্পাদক। আজকে অন্যন্যা তুমি – তে থাকছে প্রিয় আপাকে নিয়ে।
৫ বছর বয়সে সঙ্গীতা ইমাম পা রেখেছিলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। আজ থেকে ৩২-৩৩ বছর আগেও খুব সকালে নিয়মমাফিক পা রাখতেন সেখানে। এ
খনো খুব সকালে ঘর থেকে বের হন চিরচেনা সে স্কুলের উদ্দেশ্যে। মাঝের কয়েকটা বছর শুধু পাল্টে দিয়েছে একই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের কারণটি। প্রায় ত্রিশ বছরে আগে স্কুলের প্রাঙ্গণে যেতেন শিক্ষার্থী হয়ে আর এখন তিনি শিক্ষিকা।

সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন সঙ্গীতা ইমাম। বাবা নাট্যব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম আর মা নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। ঢাকার মগবাজারে দাদির বাড়িতেই জন্ম তার। জন্ম থেকে আজ অব্দি সেখানেই বসবাস। তিনি বলেন, ‘আমি এমন এক পরিবারে জন্মেছি, যারা আজ থেকে আরো কয়েক যুগ আগে থেকে বেশ উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমার জন্ম হয় যখন, তখন মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আবার তিনি নাচও করেন। আমাকে দাদির কাছে রেখে মা নাচ করেছেন, পড়াশোনা করেছেন। সেসময় বিটিভিতে তিনি নিয়মিত নাচতেন। অনেক সময়ই এমন হতো আমার মায়ের নাচের অনুষ্ঠান আছে, কিন্তু বাবা হয়তো পারছেন না তাকে নিয়ে যেতে, তখন কিন্তু আমার দাদিই মাকে নিয়ে যেতেন। এসব বলার কারণ হচ্ছে, আমি বড় হয়েছি এমন মুক্তমনা মানুষের কাছেই।’
বড় মেয়ে তিনি, আদর যেমন পেয়েছেন, তেমনি শাসনের বেড়াজালেও আটকে থাকতে হয়েছে। মূলত মা শাসন করতেন, কারণ বাবার খুব আদরের মেয়ে তিনি। শাসন আর আদরের মাঝে মা-বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বেরই সম্পর্ক তার। দাদির সঙ্গেও সঙ্গীতা ইমামের সম্পর্ক বেশ দৃঢ় ছিল। ছোটবেলায় বিকাল হলেই দাদির সঙ্গে ঘুরতে বেরোতেন নিজেদের এলাকায়ই। ঘোরাঘুরি শেষে দাদি পাড়ার দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে দিতেন। এসব কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে সঙ্গীতা বলেন, বলা চলে, নিয়ম করে দাদির সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার পেছনে সেটাও কারণ ছিল।
তার মুখেই শোনা হয়, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, গোলাম মোস্তফা, বুলবুল আহমেদসহ নানা গুণীজন থাকতেন সে এলাকায়ই। সেখানে সবার সঙ্গেই সবার সম্পর্ক বেশ নিবিড় ছিল। সবাই মিলে যেন একটি পরিবার। ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে সঙ্গীতা বলেন, খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম না, গল্প করে কাটিয়ে দিতাম অবসর। শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। আবার সুবর্ণা মোস্তফা ছিলেন আমাদের সিনিয়র। আমরা সবাই একই স্কুলে পড়তাম। একসঙ্গে গল্প করতাম, নাচ শিখতাম, গান করতাম। শমী কায়সার আবার আমার ছোট। ও আমার কাছে আসত নাচ শিখতে। এভাবেই আমাদের শৈশব-কৈশোর পার হয়েছে। এলাকার সবার সঙ্গেই সবার হূদ্যতা ছিল, কেমন একটা অদৃশ্য বন্ধন ছিল।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি সঙ্গীতা ইমামের। কিন্তু মা যেহেতু পড়েছেন দর্শন শাস্ত্র নিয়ে, তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে বেছে নেন দর্শন। সেসময় ডাকসুর সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তার। সেখানে নাচের দায়িত্বে ছিলেন। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যাতায়াত ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সেসব দিন বেশ ভালোই কেটেছে বলে জানান তিনি। এভাবেই স্নাতকোত্তর পর্ব চুকিয়ে ফলাফল বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টুকু অযথা নষ্ট না করে কিছু একটা করার উদ্দেশ্যে নিজের স্কুল ভিকারুননিসায় যোগ দেন। একটা সময় টের পেলেন ভালোবেসে ফেলেছেন এ পেশাকেই। সেই থেকে আজো আছেন এখানেই।
মেধা বিশ্বাস করা আর ভবিতব্যে বিশ্বাস করা তো এক বিষয়, এভাবেই ভাবেন সঙ্গীতা ইমাম। শিশুরা হাসতে হাসতে স্কুলে যাবে, খেলতে খেলতে শিখবে, এমনটাই চাওয়া তার। খুব শখ করে পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নিয়েছেন তিনি, বিষয়টি এমন না হলেও এখন তার দিন থেকে রাত আবর্তিত হয় স্কুল ঘিরেই। এখানেই যেন প্রাণ খুঁজে পান। তাই হয়তো এখনো মেনে নিতে পারেন না পড়াশোনায় প্রতিযোগিতার বিষয়টিকে।
তার মতে, বর্তমানে আমরা শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি আমাদের চাওয়াগুলো। একটা শিশুকে এখন বিদ্যালয়ে পা দেয়ার আগেই তাবৎ দুনিয়ার সবকিছু জেনে আসতে হয়। অথচ এমনটা তো হওয়া উচিত নয়। শিশুকে মেধার পরীক্ষাইবা দিতে হবে কেন। মেধার দৌড়ে কে কতটা পথ পাড়ি দেবে, সেটা তো অনিশ্চিত, সেদিকে থেকে বিবেচনা করলে খুব অল্প বয়সে তাদের ওপর আসলে বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটছে না, সে বন্ধু তৈরি করতে পারছে না, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। তাই তো দিন দিন মানুষের গায়ে লাগছে অসামাজিক তকমাটি।
সঙ্গীতা ইমামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি যথেষ্ট বন্ধুবত্সল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে বেশ মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন, এখন অনেক বন্ধু তার। ছোটবেলায় বেশ অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে সেভাবে বন্ধু তৈরির সুযোগ ঘটেনি। তবে অল্পসংখ্যক বন্ধুদের কাছে তিনি অন্তর্মুখী নন একদমই। বরং বন্ধুদের কাছে তিনি খোলা বইয়ের মতো।
সাংগঠনিক কাজ বরাবরই তাকে টানে। ছোটবেলা থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন খেলাঘর, লোকনাট্যদলের মতো সংগঠনগুলোর সঙ্গে। বাবা বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সভাপতি থাকায় এ সংগঠনের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা অনেক আগে থেকেই। তবে সাংগঠনিকভাবে সম্পৃক্ত হন ২০০১ সালে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত হন ২০০৩ সালে। বর্তমানে বৃহত্তম এ সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক তিনি।
দুই সন্তানের জননী সঙ্গীতা ইমাম ভালোবাসেন গল্প করতে, বই পড়তে আর গান শুনতে। সময় পেলেই দুই ছেলের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। পরিধানের পোশাক হিসেবে শাড়িই তার পছন্দ, সেসঙ্গে টিপ আর চুড়ি পছন্দের অনুষঙ্গ।