সন্তানকে কীভাবে দেবেন যৌনশিক্ষা?

খেতে খেতে বসে আচমকাই একদিন জোর ধাক্কা খেয়েছিলেন রাহুল ও পিয়ালি সেনগুপ্ত। সেদিনও নানা টুকটাক ব্যাপারে আলোচনা চলছে ডিনার টেবিলে, তাঁদের দশ বছরের মেয়ে মধুঋতাও যোগ দিচ্ছে সে সব কথাবার্তায়। মেয়েকে স্কুলে কী কী হল সে সব নিয়ে নানা প্রশ্ন করছিলেন অধ্যাপক রাহুল। হঠাৎ করেই বোমা পড়ার মতো একটা প্রশ্ন ছুড়ল মধুঋতা, ‘‘আচ্ছা বাবা, অরগ্যাজ়ম মানে কী গো?’’ মা-বাবা তো বটেই, ঠাকুরদা-ঠাকুমাও জোর বিষম খেলেন। মেয়ে চারজনের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল, কিছু একটা গোলমাল সে না চাইতেই করে ফেলেছে, কোনওক্রমে খাওয়া শেষ করে টেবিল ছাড়ল সবাই। রাহুল বলছিলেন, ‘‘সেদিন রাতে আমাদের ঘুম আসছিল না। পিয়ালি আর আমি বুঝতে পারিনি যে এত তাড়াতাড়ি এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে! তবে সেই সঙ্গে এটাও আন্দাজ করতে পারছিলাম, যদি প্রশ্নের উত্তরটা ও না পায়, তা হলে অন্য পথে জানার চেষ্টা করবে আর ভবিষ্যতে কোনওদিন এই ধরনের জিজ্ঞাসা নিয়ে আমাদের দ্বারস্থ হবে না। তাই সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।’’
প্রথম ধাপ
বিজ্ঞান কিন্তু এ তথ্য মেনে নিয়েছে যে পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধির সময়টা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তাড়াতাড়ি পরিণত হয়ে উঠছে মন। কাজেই দশ বছরের সন্তানের মুখে অরগ্যাজ়ম সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনে ছিটকে পড়ে যাবেন না। তার উপর ইন্টারনেট আছে, টেলিভিশন আছে। চাইলে যে কোনও প্রশ্নর উত্তর ওরা মুহূর্তেই জেনে নিতে পারে, আপনার অপেক্ষায় বসে থাকার কোনও দরকার নেই। এই বয়সের বাচ্চারা বন্ধুবান্ধবদের কথাকে আপ্তবাক্য বলে মনে করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেক্স সম্পর্কে গোড়াতেই ভুলভাল ধারণা তৈরি হয়ে যায় তাদের সূত্রে পাওয়া ভ্রান্ত তথ্য থেকে। সেটা এড়াতে চাইলে সন্তানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। প্রথম থেকেই একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় যাওয়ার দরকার নেই, তবে যৌনতা সম্পর্কে যেন একটা ধারণা থাকে সেটা দেখবেন। তাতে কৌতূহল নিয়ন্ত্রিত হবে অনেকটাই।’
প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকবেন না
কিছু বাচ্চা যেমন মনের কথা পরিষ্কার করে গুছিয়ে বলতে পারে, তেমন আবার অনেকেই আছে যারা পারে না। যদি মনে হয় যে আপনার সন্তানের পরিণতিবোধ এসে গিয়েছে তা হলে নিজেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু মনোবিদরা বারবার বলেন যে কতটা বলবেন, সেটা আগে থেকে ভেবে নিন। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কিশোর/ কিশোরীটির মূল জিজ্ঞাসাগুলিকে মেটানো, কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দেওয়া নয়। তাই খুঁটিনাটি এড়িয়ে চলাই ভালো।
পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিন
সন্তানের বয়স 13-14 হলেই তার শরীর জুড়ে দাপাদাপি শুরু করে দেবে হরমোনের বাড়বাড়ন্ত। এতদিন কোনও উৎসাহ না থাকলেও এবার থেকে তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ বোধ করবে এবং যৌন চিন্তাভাবনাও মাথায় আসাটা স্বাভাবিক। অনেকেই তাই ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধির দিকে গেলেই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মেলামেশায় বাধা সৃষ্টি করেন। টিভি বা ইন্টারনেট ব্যবহারের উপরও আরোপিত হয় বিধিনিষেধ। আজকের যুগে এর কোনওটাই স্বাভাবিক সমাধান হতে পারে না। তার চেয়ে বরং অনেক কার্যকর হবে পুরো বিষয়টা নিয়ে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করলে। বয়ঃসন্ধি পর্ব থেকেই যৌন সংক্রমণের ফলে হওয়া নানা অসুখবিসুখ এবং এইচআইভি/ এইডস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত, একমাত্র সে ক্ষেত্রেই এই রোগগুলির মারণ আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। সন্তান যেন তার যে কোনও জিজ্ঞাসা নিয়ে মা-বাবার কাছে আসতে পারে, সেই রাস্তাটা সব সময় খুলে রাখুন। যে মুহূর্তে তারা বুঝতে পারবে যে আপনি তাদের কাজটা ঠিক না ভুল, উচিত বা অনুচিত তার বিচার করছেন, সেই মুহূর্তেই সে গুটিয়ে যাবে।
স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক
ইন্টারনেট আর টেলিভিশনের দৌলতে অজস্র যৌনগন্ধী কনটেন্ট এখন কিশোর-কিশোরীদের হাতের নাগালেই থাকে সব সময়। মনোবিদরা বলেন, সেই কারণেই আরও বেশি করে বোঝানো দরকার যে টিভি বা সিনেমায় যেমন দেখায়, আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। সন্তানকে বোঝান প্রেম আর যৌনতা কেবল রূপকথার মতো সুন্দর নয়, অসাবধান হলেই খুব বড়ো বিপদ হতে পারে। অনেক সময় স্রেফ বন্ধুবান্ধবদের চাপে পড়েই অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যদি একবার তলিয়ে ভেবে দেখেন, তা হলেই নিজের কিশোরবেলার কথা মনে পড়ে যাবে। বুঝতে পারবেন যে ঠিক এই একই পরিস্থিতিতে একদিন আপনিও ছিলেন। তাই যৌনতাকেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাবলে কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে বিষয়ে সন্তানকে বুঝিয়ে বলতেও আপনার খুব একটা সমস্যা হবে না।
ছক ভাঙা ভাবনা
সন্তানের যৌন পছন্দ যদি ছকভাঙা হয়, অর্থাৎ সে সমকামী বা বাইসেক্সুয়াল হয়, তা হলেই অধিকাংশ অভিভাবকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আজও। কিন্তু তার যৌন পছন্দটাকে সম্মান জানানোর দায়িত্বও আপনাকেই নিতে হবে। সন্তান সমকামী হলে মেনে নিন৷ মনে রাখবেন, আপনিই কিন্তু এরকম একটা চ্যালেঞ্জের মুহূর্তে সন্তানের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়৷
What's Your Reaction?
আমি সামিরা ইসলাম। ফেমিনাইরা-তে কন্ট্রিবিউটর হিসাবে কাজ করছি। আমার লেখা কিংবা প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনও মতামত থাকলে আমার লেখার নিচে কমন্টে করতে পারনে।