“চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে”, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি সুন্দর গানে গানে চোখের গুরুত্ব জানিয়ে গেলেন সকলকে। অথচ সুন্দর এই পৃথিবীটাকে দেখায় যে চোখজোড়া তাদের প্রতিই কিনা আমাদের রাজ্যের অবহেলা! প্রযুক্তির এ যুগে সব কাজ যেমন হচ্ছে সহজসাধ্য ঠিক তেমনি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চোখ, কান এবং ত্বক সহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সাধারণ কিছু দৈনন্দিন অভ্যাস আর পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে ও নানা রোগের ঝুঁকি এড়াতে আমাদের সাহায্য করবে। তাছাড়া অনেকক্ষণ এক নাগারে কাজ বা পড়াশোনা করলে মস্তিষ্ক ও চোখের উপরে চাপ পড়ে। আপনি কি জানেন ম্যাসাজের মাধ্যমে চটজলদি এই ক্লান্তিও তাড়িয়ে আবার প্রফুল্লচিত্তে কাজ শুরু করতে পারেন। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? চলুন জেনে নেই চোখের যত্নে আমাদের করণীয় সম্পর্কে –
অভ্যাস পরিবর্তন
অনিয়মিত জীবনযাত্রা, অপর্যাপ্ত ঘুম, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ইত্যাদি কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। মোবাইল, কম্পিউটারের অত্যাধিক ব্যবহার অথবা সারাদিন টেলিভিশন দেখার কারণে চোখের লুব্রিকেন্ট বা জলীয় পদার্থ শুকিয়ে যায়। ফলে দেখার ক্ষমতা কমে গিয়ে অন্ধও হতে পারেন। তাই আমাদের উচিত ঘন্টা খানেক পরপর ঠান্ডাপানি দিয়ে চোখ ধোয়া।
দিনেরবেলা UV Protected Sunglass or Goggles ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরী কেননা সূর্যালোকের অতিবেগুনিরশ্নি চোখের জ্যোতি কমিয়ে দেয়। ছোটবাচ্চারা অনেকেই রাতেরবেলা কম আলোতে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে থাকে। আমরাও অনেকে একসময় এমন করতাম কেউ কেউ তো এখনো করেন। অপর্যাপ্ত আলোতে কাজ করা ও বই পড়া দুইই সমান ক্ষতিকারক।
মানব চোখ ও তার গঠনঃ
চোখের বিভিন্ন রোগ ও তার লক্ষণ
১. ছানিপড়া (Cataract)
চোখের কর্নিয়া ও আইরিশের কাছাকাছি স্বচ্ছ লেন্স অস্বচ্ছ হয়। দৃষ্টিক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পাওয়া, চশমার পাওয়ার বাড়তে থাকা, আলোর চারিদিকে রংধনু দেখা, একটি জিনিসকে দুইটি দেখা, আলোতে চোখ ঘোলাটে হয়ে আসা ইত্যাদি ছানিপড়ার লক্ষণ।
২. গ্লোকোমা(Glaucoma)
ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপ থাকলে এটি বেশি হতে পারে। বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসতে পারে। হঠাৎ করে এক চোখে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, তার সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব। আবার সবসময় হালকা চোখের এবং মাথা ব্যথার অনুভূতি (বিশেষ করে কম আলোতে) এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টি শক্তি কমে যেতে পারে। অন্য দিকে ব্যথাবিহীন উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এবং চশমার পাওয়ার পরিবর্তন নিয়েও রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে মাঝে মাঝে। দৃষ্টিসীমানার যেকোনো এক পাশে কালো হয়ে যাওয়া, ছানি পেকে চোখ লাল হওয়া ইত্যাদি এ রোগের উপসর্গ হতে পারে। জন্মগত বড় চোখ, চোখ হতে পানি পড়া এবং আলোতে চোখ বন্ধ করে ফেলা জন্মগত গ্লোকোমার লক্ষণ।
ট্যারাচোখ
একটি জিনিসকে দু’টি দেখা, দৃষ্টিস্বল্পতা, মাথাধরা ইত্যাদি ট্যারা চোখের প্রাথমিক লক্ষণ। প্রাথমিকভাবে মাঝে মাঝে চোখ টেরা হলেও আস্তে আস্তে তা স্থায়ী রূপ নেয় । চিকিৎসার মাধ্যমে ও চোখের কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে এটি সারানো সম্ভব।
এছাড়াও রক্তক্ষরণ, মাংস বৃদ্ধি, চোখের প্রদাহ ইত্যাদি নানাপ্রকার রোগ হতে পারে। এদের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের জ্ঞান রাখতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস
এত এত রোগ নিয়ে বক বক করে ভয় পাইয়ে দিলাম তাই না? হা হা হা। ভয় নেই! পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসই সব রোগকে ধুলোয় মিশিয়ে দিবে। চোখের জন্য সবচেয়ে জরুরী কোন ভিটামিন বলতে পারেন? হ্যাঁ একদম। ভিটামিন ‘এ’। মলা ঢেলা মাছে ভিটামিন এ আছে তা তো আমরা সবাই জানি। তবে গাজর, পালংশাক, ডিম এগুলোতেও কিন্তু ভিটামিন এ আছে।এছাড়া ভিটামিন সি, ই ও জিংক সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন ফলমূল, শাকসবজি, সূর্যমুখীর বীজ, শিম, মটরশুঁটি, কলাই, বিভিন্ন প্রকার ডাল ইত্যাদি এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। বাদাম ও মাছের তেলে আছে OMGA and Fatty acids যা চোখ শুষ্ক হতে দেয় না। এভাবে দর্শন শক্তি বৃদ্ধি করে। আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
চোখের ম্যাসাজ
এই এতো বড় লিখাটা পড়তে পড়তে ক্লান্ত? অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে করতে ক্লান্তিতে ঘাড়, মাথা, চোখ সব ব্যথা করছে? তাহলে দ্রুত পড়ে ফেলুন আর জেনে নিন কিভাবে চোখে ম্যাসাজ করে মস্তিষ্ক ও চোখের ক্লান্তি দূর করবেন।
Acupuncture points and accupuncture treatment – প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই পদ্ধতিতে শরীরের নির্দিষ্ট জায়গার সাহায্যে নানা সমস্যা সমাধান করে এসেছে। ম্যাসাজের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা যেন অবশ্যই ক্লকওয়াইজ ও এন্টিক্লকওয়াইজ হয়। এলোমেলো করলে তা আর ম্যাসাজ থাকবে না বরং কচলানো হয়ে যাবে।
১. নাকের পাশে চোখের শুরুর প্রান্তে আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করতে হবে। এটি চোখের লুব্রিকেন্ট স্বাভাবিক রাখে। ক্লান্তি দূর করে। একইভাবে চোখের শেষপ্রান্তে যেখানে আই সকেট শেষ হয়েছে সেখানে ম্যাসাজ করতে হবে। দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে করতে চোখে ব্যথা হলে এটি সহায়ক।
২. চোখের মাঝখান বরাবর ঠিক ভ্রূ এর একটুখানি উপরে ম্যাসাজ করতে হবে।
৩. চোখের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে যেখানে ডার্ক সার্কেল হয় সেখানে ম্যাসাজ। ৩০ সেকেন্ড ধরে। এটি ডার্ক সার্কেল ও ক্লান্তিভাব দূর করে। ডার্কসার্কেলের কথা যখন এলোই আরেকটা কথা বলা দরকার। যারা দীর্ঘদিন যাবত এ সমস্যায় ভুগছেন একটু নিয়মতান্ত্রিক জীবন আর খাদ্যাভাসের মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন সহজেই।
৪. চোখ বন্ধ করে চোখের উপর আলতোভাবে হাত বোলাতে থাকুন। এসময় জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিন।
আরও কিছু টিপস
কাজ করতে করতে বা পড়াশোনা করতে করতে একটু বিরতি নিয়ে দূরে কোনো কিছুর দিকে তাকান বা দূরে কোনো লিখা পড়ার চেস্টা করুন। কাছের কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে কাজ করলে আমাদের মস্তিস্ক একটি নির্দিষ্ট ফোকাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলাফল, দূরের জিনিস দেখতে ঝাপসা লাগে। এজন্য ব্রেইনের ফোকাস পরিবর্তন করা দরকার।
শুষ্ক আবহাওয়া এড়িয়ে চলুন। আমাদের অনেকের বাড়িতে এসি আছে। সার্বক্ষণিক এসির শুষ্ক বাতাসে চোখের লুব্রিকেন্ট শুকিয়ে যায়। এজন্য রাতে ঘুমাবার সময় যখন চোখ বন্ধ থাকে তখন এসি চালাতে পারেন। এতে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
মৃদু সূর্যালোকে চোখের আরাম। সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময় প্রকৃতি দর্শনে যেতে পারেন। এতে শরীর ও মন উভয়েরই উপকার হবে।