বিচ্ছেদ নয়, সুন্দর করে তুলুন হারিয়ে যাওয়া সর্ম্পক

জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক! চিরকালের বন্ধন! বিয়ে নিয়ে এরকম নানা শব্দবন্ধ অল্পবয়স থেকেই শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা অনেকেই। কিন্তু যেহেতু জীবনটা রূপকথা নয়, তাই সেখানে ঘটে চলা পরিস্থিতিগুলোও যে স্বপ্নের মতো হবে না, তা বুঝতে বিশেষ বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার পড়ে না! প্রথম দেখায় যাকে ভীষণ ভালো লেগেছিল, প্রেম হওয়ার পর মনে হয়েছিল একে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়, বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ধারণায় একটু একটু করে চিড় ধরতে শুরু করে। সম্পর্কে তৈরি হয় দূরত্ব, আর তা থেকে শুরু হয় নৈমিত্তিক অশান্তি। বহু ঘটনা শেষ হয় আদালতে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে, আবার পরিস্থিতির চাপে অসহ্য হয়ে ওঠা সম্পর্কও টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য হন অনেকে।
এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার সত্যিই কি কোনও উপায় রয়েছে? বিচ্ছেদই কি একমাত্র ভবিতব্য? নাকি একটু চেষ্টা করলে ফের সুন্দর করে তোলা যায় বিষিয়ে ওঠা সম্পর্ক? যদি পরিস্থিতি জটিলতর হয়, স্বামী যদি অত্যাচারপ্রবণ হন, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হন বা ওঁর মধ্যে অন্য কোনও সমস্যা থেকে থাকে, তা হলে বিচ্ছেদ ছাড়া সত্যিই উপায় নেই। কিন্তু যদি আপনাদের মধ্যে সময়ের নিয়মে বা অন্য কোনও বাহ্যিক কারণে দূরত্ব জন্মে থাকে, তা হলে সেটা মেটানোর সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি নিয়েই আলোচনা করব।
সমস্যাটাকে চিহ্নিত করুন
অদিতি আর অভিমন্যুর বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক। তিনবছরের মাথাতেই সম্পর্ক টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছোয়। ‘‘এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারতাম না,’’ বলছেন অদিতি, ‘‘সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম ডিভোর্সের রাস্তায় হাঁটার।’’ পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত শোচনীয়, এক কমন বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেন অদিতি। বান্ধবী অভিমন্যু ও অদিতিকে বোঝান একবারের জন্য হলেও রিলেশনশিপ কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়ার জন্য। ‘‘কাউন্সেলরের সঙ্গে গোটাতিনেক সেশনের পরে আমরা আমাদের সম্পর্কে গজিয়ে ওঠা সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে শুরু করি,’’ বলছেন অভিমন্যু। কাউন্সেলরের কথায় নিজেকে অল্প অল্প করে পালটাতে শুরু করেন তিনি। ‘‘আমিও অল্পে অধৈর্য হয়ে পড়াটা সচেতনভাবে আটকাতে চেষ্টা করছিলাম,’’ বলছেন অদিতি। চেষ্টার ফল ফলেছে। ফের সুখেশান্তিতেই ঘর করছেন দু’জনে!
মন খুলে কথা বলুন
খোলা মনে কথা বললে বহু সমস্যারই সমাধান সম্ভব। ম্যারেজ কাউন্সেলরের কাছে যাওয়ার পর তাঁরা প্রথমেই যে পরামর্শটা দেন, তা হল নিজের ভিতরে জমিয়ে রাখা যাবতীয় অভাব-অভিযোগ-অপ্রাপ্তির কথাগুলো মন খুলে বলে ফেলার। পরস্পরের না-বলা অভিযোগগুলো জানতে পারলে সুবিধে হয় সমস্যাটা সমাধানের পথে এগনোর। স্বামীকে জানান, ওঁর সঙ্গে আপনি কিছু কথা বলতে চান। নিরিবিলিতে বসে ঠান্ডা মাথায় নিজের কথা বলুন। এ সময়টা সেলফোন বন্ধ রাখবেন, স্বামীকেও বলুন ওঁর ফোনটা বন্ধ করে দিতে। আর হ্যাঁ, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন না। যুক্তি দিয়ে কথা বলুন। কান্নাকাটি না করাই ভালো!
কথা শুনতেও শেখা দরকার
এই সাধারণ কথাটা আমরা অনেকেই মনে রাখি না! নিজের কথা বলতে গিয়ে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন অনেকে যে, উলটোদিকের মানুষটিরও যে কিছু বলার থাকতে পারে, সে বিষয়টা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে এটা একেবারেই চলবে না! আপনার মনে অনেক ক্ষোভ জমা আছে বলে স্বামীর বক্তব্য শুনবেন না, এটা হতে পারে না! কাজেই ওঁকেও ওঁর কথা বলার সুযোগ দিন, সহানুভূতির সঙ্গে শুনুন। এই কথোপকথনের মধ্যে কোথাও যেন পারস্পরিক দোষারোপের ছায়া না পড়ে! পরস্পরের অভাব অভিযোগগুলো মন দিয়ে শুনলে সমস্যার সমাধান করা অবশ্যই সম্ভব!
ফিরিয়ে আনুন বন্ধুত্বের আমেজ
সারাক্ষণ যেখানে ফাটাফাটি ঝগড়া বা কটাক্ষ লেগেই থাকে, সেখানে হঠাৎ করে বন্ধুত্বের আবহ ফিরিয়ে আনা কঠিন। কিন্তু আপনাদের মধ্যে যদি শুধু মতের অমিলজনিত সমস্যাই থাকে, তা হলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। এ ক্ষেত্রে যদি একজন অপরজনকে আমূল বদলে নিজের মতো করে নিতে চান, সেটা কিন্তু সম্ভব নয়। নিজের নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেও কতটা পরস্পরের মনের কাছাকাছি আসা যায়, সেটাই এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর বন্ধুত্বই তার একমাত্র পথ। বন্ধুরা পরস্পর খোলা মনে অনেক কিছু আলোচনা করতে পারেন। রিলেশনশিপ কাউন্সেলররাও বলেন, যে সব স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বন্ধুত্ব একটা বড়ো জায়গা জুড়ে থাকে, তাঁরা সুখী হন বেশি। তাই একটু চেষ্টা করুন সম্পর্কটাকে হালকা করতে। সাধারণ বিষয় নিয়ে গল্প করুন, অন্য বন্ধুদেরও ডেকে নিন, কলেজ জীবনের আমেজটা ফিরিয়ে আনুন।
পরস্পরের প্রতি সৎ থাকুন
সবচেয়ে জরুরি পয়েন্ট এটা। আপনি নিজে ভিতর থেকে যা, তাই থাকুন। অন্য কিছু সাজতে যাবেন না। অনেক সময়ই আমরা নিজেকে অপরের চেয়ে ভালো প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক কিছু ভান করি। সুস্থ সম্পর্কের পথে তা অন্তরায়। নিজে যা বিশ্বাস করেন, সেই কথাই বলুন, সেভাবেই কাজ করুন। বানিয়ে বানিয়ে ভালো ভালো কথা বলার দরকার নেই। স্বামীর কোনও আচরণ যদি আপনার ভালো না লাগে, স্পষ্ট জানান। একইভাবে ওঁর কাছ থেকেও জানতে চান আপনার কোন দিকটা উনি পছন্দ করছেন না। নিজের দোষ শোনার সময় রেগে যাবেন না। স্বামীকেও ঠান্ডা মাথায় আপনার বক্তব্য শুনতে বলুন। দু’জনের মধ্যে এই মৌলিক সততাটুকু থাকলে পরবর্তী কথাবার্তার পথ সুগম হবে।
কিছুদিন আলাদা থেকে দেখুন
পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্থ করে তুলতে কোনও কিছুই যদি কাজ না করে, তা হলে একটু অন্যভাবে ভেবে দেখতে পারেন। এ কথা তো ঠিকই যে, সম্পর্কে তিক্ততা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু প্রথমেই বিচ্ছেদের পথে না হেঁটে নিজেদের মতো করে একটা চেষ্টা করুন। আইনি পথের সাহায্য না নিয়ে আলাদা জায়গায় থাকতে শুরু করুন। এই সময়টা চেষ্টা করবেন পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে। যদি আপনাদের মধ্যে সামান্যতম ভালোবাসার টানও থেকে থাকে, তা হলে একে অন্যের অভাববোধ আপনারা উপলব্ধি করবেন। সে ক্ষেত্রে আপনাদের কাছে সুযোগ থাকবে নতুন করে জীবন শুরু করার। মনে রাখবেন নতুন করে সব কিছু শুরু করার কিন্তু কোনও বিশেষ সময় হয় না!
What's Your Reaction?
আমি এডভোকেট সুলতানা মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটর লেখক হিসাবে ফেমিনাইরা-তে লিখছি। নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধসমূহ আইন নিয়ে আমি কাজ করি। আপনি যদি নারী বিষয়ক কোনও আইন জানতে চান তাহলে আমাদেরকে ইমেইল করুন: [email protected] । আমরা আপনার বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।